নিজস্ব প্রতিবেদক :: চট্টগ্রামে হাতির আক্রমণে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ৫ বছরে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৪ জন। পাহাড় কাটায় হাতির আবাসস্থল ও খাদ্য কমে যাওয়া, চলাচলের পথ (করিডোর) বাধাগ্রস্ত, সীমান্তে কাটা তারের বেড়া ও ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার কারণে বার বার লোকালয়ে নেমে আসে বন্য হাতি। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে হাতির আক্রমণে হতাহতের ঘটনা বেড়ে চললেও বন বিভাগের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
হাতির আক্রমণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় হাতির পাল তাড়ানো এবং মানুষকে সচেতন করার জন্য এলাকাভিত্তি এলিফ্যান্ট রেস্পন্স টিম (ইএফটি) রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সুবিধা বা ভাতা না পাওয়ায় ইএফটির সদস্যরা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এখন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে জানায় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারায় ৪ জন। ২০১৭ সালে ৯ জন, ২০১৮ সালে ১৮ জন, ২০১৯ সালে ১৭ জন এবং ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে গত দেড় বছরে আনোয়ারায় হাতির আক্রমণে মারা যায় ৭ জন। এছাড়াও চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, চকরিয়া, বান্দরবানের লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় হাতির আক্রমণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কারণ এই রুটটি হচ্ছে হাতির চলাচলের (করিডোর) পথ।
আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের এলিফ্যান্ট রেস্পন্স টিম লিডার সোহেল জানান, গত ৮ মাস আগে আমাদের টিম গঠন করা হয়। আমরা সারারাত জেগে হাতি পাহাড়া দিতাম। যেহেতু আমাদের নির্ঘুম রাত কাটতো, সকালে আমরা কোন কাজ করতে পারতাম না। রাতে চা-নাস্তা খাওয়া বাবদ আমাদের মাসে ৩-৪ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু বনবিভাগ থেকে আমাদের কোন টাকা প্রদান করা হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করছি। অনেকবার নিজেও হাতির আক্রমণের শিকার হয়েছি। আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় এখন আর কেউ কাজ করতে চাচ্ছে না।
এলাকাবাসী ও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনোয়ারায় ৩টি হাতি রয়েছে। এরমধ্যে লেজ কাটা পুরুষ হাতিই বেশি আক্রমণ করেছে। তবে হাতি তাড়ানোর আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই।
বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ের বন কেটে উজাড় করার ফলে হাতি চলাচলের পথ নষ্ট হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় হাতির প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। আবাসস্থল এবং মিয়ানমারে প্রবেশের সুযোগ না থাকায় টেকনাফ থেকে হাতিগুলো এসেছে চুনতি অভয়ারণ্যে। সেই হাতিগুলো এখন চট্টগগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া ও বোয়ালখালী পর্যন্ত আসে।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, আমি আনোয়ারা যোগদানের পর হাতির কয়েকটি আক্রমণ আমি দেখেছি। এসব দেখে ২০১৯ এর জুনে আমি বন বিভাগকে বলেছি, হাতি এলাকাবাসীর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করছে, আপনারা কোন ব্যবস্থা নেন। বৈরাগ ইউনিয়ন পরিষদে একটি মিটিং করা হয়। সেই মিটিংয়ে বন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক (হাতি নিয়ে যিনি গবেষণা করেন) ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আমরা মিটিংয়ে তাদের বলেছি, হাতিগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেয়া যায় কিনা? বন বিভাগ বলেছে, এখান থেকে হাতি সরিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। হাতিগুলো যেভাবে আসছে, সেভাবেই চলে যাবে। পরে বন বিভাগ কয়েকটি এলিফ্যান্ট রেস্পন্স টিম (ইআরটি) গঠন করলো। টিমের সদস্যদের হাতি তাড়ানোর জন্য বাঁশি, টর্চ লাইট দেয়া হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, যখন হাতি আসে, এই টিমের সদস্যরা বাঁশি এবং লাইট দিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে। যারা টিমে কাজ করবে তাদের কোন ভাতা বা সম্মানী দেয়ার সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন বিভাগ বলেছে- আপাতত আর্থিক কোন সম্মানী দেয়ার সুযোগ নেই। পরে তারা এ ব্যাপারে বিবেচনা করবে। পরে টিম সংখ্যা বাড়িয়ে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতি টিমে ৬ জন করে।
বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ চকরিয়া নিউজকে বলেন, বারবার লোকালয়ে হাতি আসার কারণ হচ্ছে- হাতিদের পূর্ব পুরুষরা যে রুট দিয়ে হেটেছে হাতিরা ট্রেডিশনালি সে রুট দিয়ে হাঁটতে থাকবে। আগে আনোয়ারায় তো প্রচুর পাহাড় ছিল। বিভিন্ন গাছপালার মাধ্যমে পাহাড়ি একটা পরিবেশ ছিল। আমরা যদি ২০ বছর আগের গুগল ম্যাপ দেখি, কেইপিজেড এলাকায় এখন যেখানে ফ্যাক্টরি হয়েছে সেখানে সব বন ও পাহাড় ছিল। হাতিরা ৫০-১০০ বছর আগে থেকে এখানে এসেছে, সেই কারণে তারা আসতে থাকবে। এখন সেখানে হাতিরা গিয়ে যখন দেখছে সেখানে বসবাসের জায়গা এবং খাওয়ার নেই তখন তারা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করে। পাহাড়ে হাতি যদি ঠিকমত খাওয়ার পেত এবং বসবাসের জায়গা থাকতো তাহলে হাতি বারবার লোকালয়ে আসতো না।
হাতির খাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি হাতির দৈনিক কমপক্ষে ১৫০ কেজি খাওয়ারের প্রয়োজন হয়। এখন তো পাহাড়ে এত খাওয়ার নেই। আর খাওয়ার পর হাতি স্থির থাকতে পারে না। দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা হাঁটতে থাকে। একটি হাতির দৈনিক ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। ৬০-৭০ কিলোমিটার হাঁটার জায়গা তো হাতির নেই। তাই হাতি লোকালয়ে চলে আসছে।
হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লাইটের ব্যবস্থা করা। এখন যেসব জায়গায় হাতি যাচ্ছে সেখানে লাইটের ব্যবস্থা করলে ওই দিকে হাতি যাবে না। এছাড়া মানুষকে সচেতন করতে হবে। রাতে ও ভোরে অকারণে বাড়ি থেকে বের না হওয়া এবং বের হওয়ার সময় টর্চ লাইট নিয়ে বের হওয়া। অনেকে আবার হাতির চোখে লাইট মারে। এতে হাতি উত্তেজিত হয়ে যায়।
এলিফ্যান্ট রেস্পন্স টিম (ইআরটি) মেম্বারদের আর্থিক সহযোগিতার ব্যাপারে এই কর্মকর্তা বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জেলা প্রশাসনের তো বরাদ্দ থাকে। কোন এলাকায় যদি বন্যা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তাহলে জেলা প্রশাসন তাৎক্ষণিক সেখানে গিয়ে তো আর্থিক সহযোগিতা করে। এই যে হাতির আক্রমণে মানুষ মরছে। তারা এটাকে কেন দুর্যোগ মনে করতে পারছে না। বনবিভাগ ইআরটির মেম্বারদের হাতি তাড়ানোর প্রাথমিক ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়েছে। আমরা তাদের আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য চেষ্টা করছি।
আনোয়ারা ১নং বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সোলাইমান জানান, হাতির আক্রমণের ব্যাপারে বনবিভাগের কোন কার্যক্রম বা ব্যবস্থা নেই। হাতি আক্রমণ করলে আমরা তাদের খুঁজেও পাই না। লাইটিং এর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অনেক লাইট লাগিয়েছি। বন বিভাগ কিছুই করেনি। রাতে হাতি পাহাড়া দেয়ার জন্য এলাকার কিছু ছেলে ঠিক করেছি, বন বিভাগ তাদের কোন আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করেনি।
পাঠকের মতামত: